বই কিনে কেউ কোনোদিন দেউলিয়া হয় না। বলেছেন, সৈয়দ মুজতবা আলী। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তাঁর জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়। আর জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন-বই, বই এবং বই বলেছেন লিও টলস্টয়। বিখ্যাতজনদের এই উক্তিগুলোই বলে দেয়, একজন মানুষের জীবনে বই পড়া কতটা জরুরি। আমি মনে করি একটা মানুষের শরীর বিকাশের জন্য যেমন প্রতিদিন খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনই মানসিক বিকাশের জন্য সমান গুরুত্বের সহিত বই পড়া দরকার। লেখালেখির সাথে যারা জড়িত তাদের বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই, লেখকের আতুড়ঘর হচ্ছে গ্রন্থাগার। যিনি যত বড় লেখক তিনি তত বড় পাঠক। আর এ পাঠ বা অধ্যয়নের জন্য দরকার গ্রন্থাগার। একটা গ্রন্থাগার সভ্য মানুষ গড়ার একটা কারখানা। গ্রন্থাগার হচ্ছে একটি জাতির অগ্রগতির প্রতীক। সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির বাহন। অতীতের সাথে বর্তমানের, বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতের যোগসূত্র স্থাপন করে গ্রন্থাগার। একটি জাতির মেধা, মনন, ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারণ ও লালনপালনকারী হিসেবে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সর্বসাধারণের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারের সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রয়েছে। তাই গ্রন্থাগারকে বলা হয় ‘জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়’।
অনেকের মতে জ্ঞান অর্জনের দুটি উপায় রয়েছে। একটি হলো ভ্রমণ করে আর অপরটি হলো বই পড়ে। ভ্রমণ করে জ্ঞান অর্জন করতে হলে বিত্তশালী হতে হয়। কারণ ভ্রমণ করতে প্রচুর টাকা পয়সার প্রয়োজন হয়। তাই আমরা জ্ঞান অর্জনের সহজ মাধ্যম হিসাবে বইকে বেছে নিতে পারি। আমাদের এই সমাজে যে হারে সন্ত্রাস, অন্যায়, অবিচার এবং মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে তার মূলে রয়েছে গ্রন্থাগার বিমুখতা। বর্তমানে আমাদের যুব সমাজ যেভাবে অপসংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো যুবসমাজকে গ্রন্থাগার মুখী করে তোলা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইতো। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। আর এই গ্রন্থাগার যিনি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি নিঃসন্দেহে একজন আলোকিত মানুষ। এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটিও নিঃসন্দেহে একটি আলোকিত প্রতিষ্ঠান। এমনই একটি আলোকিত প্রতিষ্ঠান চেতনায় স্বদেশ গণগ্রন্থাগার। প্রতিষ্ঠানটির স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা আমার প্রিয়জন ও প্রিয় মানুষ শ্রদ্ধেয় আমির হোসেন স্যার। তিনি একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিকও বটে। যাঁর রয়েছে উল্লেখযোগ্য অনেক সৃষ্টিকর্ম ও সৃজনশীল কাজ। কথাসাহিত্যিক আমির হোসেন স্যার একজন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী, গুণি মানুষ। তিনি একাধারে একজন কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, গবেষক, আলোচক ও সংগঠক। কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, গবেষণা, ছড়া সম্পাদনাসহ বহু গ্রন্থের প্রণেতা এই লেখক নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন দেশ ও দেশের বাইরের অসংখ্য জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যের পাতা, শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যের ছোট কাগজ বা লিটল ম্যাগ, সাহিত্য সংকলন ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি লেখালেখিকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। এই মহান ব্রত পালনে নিজের সমস্ত মেধা ও শ্রম ব্যয়ে তিন দশকেরও বেশি সময় সাহিত্য সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। সাহিত্য সৃষ্টি, সম্পাদনা, প্রগতিশীল আন্দোলন, পাঠাগার আন্দোলনসহ নানামুখী সাংগঠনিক তৎপরতার ফলে তিনি দেশ-বিদেশের মানুষদের কাছ থেকে কুড়িয়েছেন প্রশংসা, পেয়েছেন সম্মান। দেশি-বিদেশী নানা প্রতিষ্ঠান-সংগঠন তাঁর ঝুলি ভরিয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননায়। এপর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ত্রিশেরও অধিক। দেশ বিদেশের শতাধিক সংকলনে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এতসব সৃষ্টিশীল কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরে শিমরাইলকান্দিতে এ সুন্দর প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করিয়েছেন অনেক বাধা বিপত্তিকে মোকাবিলা করে। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। এখানে মহল্লা ও তার আশেপাশের এলাকার জ্ঞান পিপাসু মানুষজন নিয়মিত নিজেদের জ্ঞান অর্জনের জন্য যাতাযাত করছে। এলাকাবাসি অত্র প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎতের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। গ্রন্থাগারটির রয়েছে মনোরম পরিবেশ, পৌরসভার খুব গুরুত্বপূর্ণ ১১নং ওয়ার্ডে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠলেও পরিবেশগতভাবে গ্রামের মতো ছায়া মাখা স্থানটি শহরের লেখকদের কাছে একটি প্রিয় স্থান হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই।
বই পড়া ছাড়াও গ্রন্থাগারটির উদ্যোগে বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলি যথাযোগ্য মর্যাদার সহিত পালন করা হয়ে থাকে। শ্রদ্ধার সহিত পালন করা হয়ে থাকে কবি, সাহিত্যিক ও বিভিন্ন গুণীজনদের জন্ম-মৃত্যু তারিখগুলোও। গণগ্রন্থাগারটিকে ঘিরে পেশায় শিক্ষক আমির হোসেন স্যারের রয়েছে ব্যপক পরিকল্পনা। ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠানটির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ছোট বড় ফলজ, বনজ ও ফুলের গাছ। বিচিত্র রকম ফুলের সুবাস ও পাখপাখালির কূজনে চারপাশ মুখরিত থাকে সকাল বিকেল। স্যারের পরিকল্পনা আছে এই মনোহর মনোরম পরিবেশে তিঁনি চালু করবেন নৈশকালিন পাঠ ব্যবস্থা, শিশুদের জন্য কবিতা আবৃত্তির সাপ্তাহিক ক্লাশ, আর্ট শিক্ষক রেখে কোমলপ্রাণ শিশুদের জন্য চিত্র আঁকার ক্লাশ নেওয়ার। প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কার্যকরী পরিষদ এবং ২৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি সাধারণ পরিষদ। যার নেতৃত্বে আছেন আমির হোসেন স্যার নিজে ও অ্যাডভোকেট পুতুল বেগম। উক্ত দুটি পরিষদের নিরলস পরিশ্রম ও আন্তরিকতায় প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে যাচ্ছে। আজকের এ প্রতিষ্ঠানটির আরো প্রসার ঘটবে, ফুলে ফলে মঞ্জুরিত বিকশিত হয়ে তৈরি করবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার দেশের জন্য কিছু সংখ্যক সোনার মানুষ।