চাকরির বাজারের অস্থিরতা, শিক্ষকদের অসহযোগিতার মনোভাব নিয়ে পাঠদান, পরিবারের হাল ধরা, দীর্ঘ মেয়াদি স্নাতকোত্তর, উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়া, সবকিছু মিলিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) শিক্ষার্থীদের মাস্টার্সে আগ্রহ কমেছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্জিনিয়ারিং অনুষদের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্চিনিয়ারিং (সি.এস.সি) বিভাগে ২০১৬-১৭ সেশনে স্নাতকের সংখ্যা ৪৯ থাকলেও স্নাতকোত্তরে মাত্র ২০ জন শিক্ষার্থী এবং একই সেশনে আইসিটি বিভাগে স্নাতকে ছিল ৫০জন এবং স্নাতকোত্তরে ৩০ জন। রসায়ন বিভাগে স্নাতক ৪১ জন হলেও স্নাতকোত্তরে মাত্র সেটি ২৪ জন।
ব্যবসা শিক্ষা অনুষদ ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদেরও দেখা যায় একই চিত্র। মার্কেটিং বিভাগে ২০১৬-১৭ সেশনে স্নাতকে ৬২জন শিক্ষার্থী থাকলেও স্নাতকোত্তরে তা ৪৭ জন। একই বিভাগে ২০১৮-১৯ সেশনে স্নাতকে ৫৯ জন এবং স্নাতকোত্তরে ৩৭ জন। ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগে ২০১৬-১৭ সেশনে শিক্ষার্থী ছিল ৬০ জন আর মাস্টার্সে ৪৯ জন।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ২০১৭-১৮ সেশনে স্নাতকে শিক্ষার্থী ছিল ৫০জন আর স্নাতকোত্তরে ৩৪ জন। একই সেশনে লোক প্রশাসন বিভাগে স্নাতক ৫৯ জন আর স্নাতকোত্তর ৪৭। নৃবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকে ৫৫ জন স্নাতকোত্তরে ৩৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষার পরিবেশ না থাকা, একই ডিপার্টমেন্টের প্রতি আগ্রহ, সরকারি চাকরি, উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার কারণে স্নাতকোত্তরের প্রতি আগ্রহ কমতেছে দিন দিন।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মারুফ আহমেদ বলেন, ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই একটা প্রবল ইচ্ছে ছিল সরকারি চাকুরি করার। চান্স পাওয়ার পর থেকেই ২য় বর্ষে থাকাকালীন আমি বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে থাকি। কিন্তু বাংলাদেশে এক বিসিএসের কার্যক্রম পুরোপুরি ভাবে সম্পন্ন হতে ৪-৫ বছর লেগে যায়৷ তাই সরকারি চাকরির আশা বাদ দিয়ে স্নাতকোত্তর না করে বিদেশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিক বিভাগের শিক্ষার্থী কামরিন সুলতানা বলেন “আমার কাছে মনে হয় এখানে স্নাতকোত্তর করা জীবন থেকে এক বছর নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই না। শিক্ষক সংকট, ৩ মাসে সেমিস্টার, চাকরিতে যোগদানের প্রেশার সব মিলিয়ে একজন শিক্ষার্থীর যে সহযোগিতা পাওয়ার কথা ছিল তা এখানে নেই।”
তিনি আরও বলেন, তাছাড়া চাকরিক্ষেত্রেও একাডেমিক পড়ালেখার চেয়ে অন্য কিছু ম্যাটার করে। তাই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো এখানে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শাহনেওয়াজ তুহিন বলেন, বিবিএ স্টুডেন্ট হিসেবে কম্পিটিটিভ ওয়ার্ল্ডে নিজেকে এগিয়ে রাখতে প্রফেশনাল ডিগ্রি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটা মাথায় রেখেই বিবিএ শেষ সরাসরি সিএতে আসা। আমার কাছে নিজেকে এগিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মাস্টার্সের চাইতে সিএ ডিগ্রি অধিকতর ভালো মনে হওয়াতে মাস্টার্স করা হয় নাই।
আইসিটির বিভাগের শিক্ষার্থী মুরাদ হোসেন সরকার বলেন, আগে থেকেই বাইরে যাওয়ার ঝোঁক ছিল, তাই রিসার্চের প্রতি গুরুত্ব দিলাম, এনিয়ে আমি বুয়েটের সাথে যোগাযোগ করলাম কিন্তু ওরা ওদের বাহিরের কাউকে টিমে নিবেনা। করোনার মাঝেই একজন গবেষকের সাথে পরিচয়। বললেন বাংলাদেশে নামেমাত্র মাস্টার্স করে সময় নষ্ট করে লাভ নাই আর দেশের বাইরে যেতে মাস্টার্স দেশে করে যাওয়া জরুরি নাহ। তাই আর স্নাতকোত্তর করা হয় নাই।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এনএম রবিউল আউয়াল চৌধুরি বলেন, একজন শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর না করা বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে আমার পর্যবেক্ষণে দুই-একটা কারণ হলো, পারিবারিক চাপ, শিক্ষকদের সাথে বনিবনা না হওয়া, আশানুরূপ সাফল্য না পাওয়া, উচ্চ শিক্ষা। তবে শিক্ষকদের দায়সারা পাঠদান, শিক্ষকের সাথে মনোমালিন্য এসব বলতে না পারার কারণে স্নাতকোত্তরের প্রতি শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারাচ্ছে।
ব্যবসা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন সরকার দীর্ঘ মেয়াদি স্নাতকোত্তরের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ২০২২ ২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে আউটকাম বেসড শিক্ষা কারিকুলাম (ওবিই) চালু হয়েছে। যেখানে ৪৫ ক্রেডিটের এমবিএ তে দেড় বছর সময় লাগে। এই সময় অধিকাংশ স্টুডেন্ট চাকরিতে প্রবেশ করে এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে চলে যায় । যার কারণে সবাই স্নাতকোত্তর করে না। এছাড়াও যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট এগ্রিগ্রেড না হলে স্কলারশিপ নিয়ে বাহিরে গেলে প্রথমে আবার মাস্টার্স করতে হয় এবং পরে পিএইচডি করতে হয়। যার কারণে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন কারিকুলাম গ্রহণ করেছে।
তবে প্রকৌশল অনুষদের সাবেক ডিন মাহমুদুল হাসান বলেন ভিন্ন কথা, তিনি বলেন ইঞ্জিনিয়ার ও আইসিটি বিভাগের শিক্ষার্থীেদের চাকরির বাজার অনেক বড়। তারা স্নাতক শেষ করেই উচ্চ বেতনে চাকরিতে জয়েন করেন যার কারণে সবাই স্নাতকোত্তর করে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন স্নাতকোত্তর যেহেতু পরেও করা যায় তাই শিক্ষার্থীরা এই ঝুঁকি গ্রহণ করে।
ওবিই কারিকুলাম সম্পর্কে (দীর্ঘ মেয়াদি স্নাতকোত্তর) বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকিউসির পরিচালক রশিদুল ইসলাম শেখ বলেন, বাংলাদেশে সাধারণ এক বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর রয়েছে। এক্ষেত্রে কোন শিক্ষার্থী যদি উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যায় তাহলে তাদের আবারও স্নাতকোত্তর করা লাগে। তাই শিক্ষার্থীদের যাতে বিদেশে গিয়ে দু’বার স্নাতকোত্তর করা না লাগে সেজন্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের সদস্য হয়েছে। যদি সেখানে তারা অ্যাক্রেডিশন কাউন্সিলের সনদপত্র দেখান তাহলে সরাসরি তারা পিএইচডি ডিগ্রি করতে পারবে। এখানে একটু সময় বেশি লাগলেও শিক্ষার মানের দিকে আমরা মনোযোগ দিচ্ছি।
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. হুমায়ন কবির চৌধুরি বলেন , এই মুহূর্তে কতজন শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর করতেছে না সেই তথ্যটি আমার হাতে নাই। কেন করছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন , হয়ত অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করতেছেন, তবে বর্তমানে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সরকারী চাকুরি ও উচ্চ শিক্ষার প্রতি ঝুঁকছে। তাই সময় নষ্ট না করে এক বা দেড় বছর তারা প্রস্তুতি নেয়।