তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উত্থান ও পতন।

লেখক: শাহরিয়ার রশিদ
প্রকাশ: ২ years ago

বর্তমান সময়ের সবচাইতে আলোচিত-সমালোচিত বিষয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই না আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।

এখন জানা যাক এই আলোচিত সরকার ব্যবস্থার উত্থান এবং পতণ সম্পর্কে। সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে নির্দলীয় অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে। এবং নির্বাচনটি গ্রহনযোগ্যতা পাই।বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্টতা না পেয়ে জামায়ত কে নিয়ে সরকার গঠন করে। এই সংসদ বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে কেননা এই সংসদে সরকার ও বিরোধী দল রাজনৈতিক ঐক্যমতের ভিওিতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। যেখানে আমাদের দেশে সরকারি দল ও বিরোধী দলের সম্পর্ক থাকে সবসময় সাপে নেউলে। কিন্তু এই সম্পর্কে চির ধরে কিছু দিনের মধ্যেই। ১৯৯৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামিলীগের সভানেত্রী পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার দাবি তুলে।এই দাবি আরো জুড়ালো হয় মাগুরা ২ আসনের উপনির্বাচনে কারচুপির পর, তখন বিরোধীদলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন আরো জুড়ালো করে এবং ২৪ এ জুন ১৯৯৪ আওয়ামী লীগে , জাতীয়পার্টি এবং জামায়াত একযোগে একটি যৌথ সংবাদসম্মেলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা তুলে ধরে এবং ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার কে সময় দেয় তা গ্রহণ করার জন্য কিন্তু সরকার এই বিষয়ে কর্নপাত না করলে ২৮ ডিসেম্বর সংসদের ১৪৭ জন সদস্য পদত্যাগ করে। ২৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫ স্পীকার তাদের পদত্যাগ পত্র গ্রহনযোগ্য নয় বলে রুলিং দেন। টানা ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকার কারনে তাদের আসন শূন্য হবে কিনা জানতে হাইকোর্টের কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় এবং হাইকোর্ট শূন্য হবে বলে রায় দেয়। তারপর ১৫ ডিসেম্বর এই শূন্য আসন গুলোতে উপনির্বাচন হবে বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষনা দেয় কিন্তু বিরোধী দল তা বর্জনের ঘোষণা দেয়। বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলনের জন্যে সরকার উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ২৪ নভেম্বর সরকার সংসদ ভেঙে দিয়ে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু বিরোধী দল গুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যেতে অসম্মতি জানায়।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যার কোনো গ্রহনযোগ্যতা রাজনৈতিক মহলে ছিল না কিন্তু কোনো বিষয়কে তোয়াক্কা না করে ১৯ ফেব্রুয়ারী খালেদা জিয়া তার নেতৃত্বে মন্ত্রীপরিষদ গঠন করে এবং ৬ ষ্ঠ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বসে। পরে বিরোধী দলের টানা হরতাল অবরোধের কারনে সরকার ২১ মার্চ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল সংসদে উস্থাপন করতে বাধ্য হয় যা ২৬ মার্চ সংসদে সর্ব সম্মতিক্রমে পাস হয়।
এই পর্যন্ত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১,১৯৯৬,২০০১,২০০৮, এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে এই নির্বাচন গুলোই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বলে পরিগনিত হয়।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারী সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষনা করে। ফলে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা পড়ে এই প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে ২০১১ সালে ১০ মে আপিল বিভাগ বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বধীন একটি বেঞ্চ ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধানের মূল স্তম্ভ” গণতন্ত্র” ( যা সংবিধানের চারটি মূলনীতির একটি অন্যতম মূলনীতি) অর্থাৎ ‘ জনগনের প্রতিনিধি মাধ্যমে শাসন ‘এ ধারনা ও আর্দশের সাথে পরিপন্থী বলে ঘোষনা করে। এই নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা তর্ক বিতর্ক ও হয়। আপিল বিভাগের রায়ের কার্যকারিতার বাধ্যবাধকতা দেখিয়ে সরকারের আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ২৫ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করে এবং ৩০ জুন সংসদে বাজেট অধিবেশন চলা কালে বিলটি পাস হয়। এর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কে চিরদিনের জন্য মুছে ফেলা হয়। এখানে আরেকটা বিষয় লক্ষনীয় যে, যেই সংগ্রাম ও রাজনৈতিক আন্দোলন এর পর রাজনৈতিক ঐক্যমতের ভিত্তিতে ত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন করা হয়েছিল তা বাতিল এর সময় এইরকম কোনো কিছুই লক্ষ করা যায়নি।

শাহরিয়ার রশিদ আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়