কিশোর অপরাধপ্রবণতা: নিরক্ষরতার ভয়াল রুপ

লেখক: মুহাম্মদ মাসুদুর রহমান ভূঁইয়া, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ: ৭ মাস আগে

“এলাকায় হঠাৎ কিশোরদের নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা এবং বিশৃঙ্খলা করার পায়তারা আমাকে শংকিত করছে।” যেমন ধরুন আতশবাজি ফোটানো,রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অযথা চেচামেচি করা, রাতে জাগ্রত থেকে শিয়ালের ডাক দেওয়া, অন্যের বাড়িতে চুরি করা(কবুতর কিংবা ডাব) এই ছোটখাটো অপরাধগুলোকে আমরা দুষ্টুমি বলে উপেক্ষা করি। কিন্তু, আমাদের মনে রাখতে হবে অনেক সময় ছোটখাটো পরিবর্তন বড় ধরনের দূর্যোগের আভাস দেয়।

একটি বাস্তব চিত্র: ফরহাদের কাহিনী

ফরহাদ, এলাকার নিরক্ষর কিশোর। জুয়াড়ি বাবা হয়ত নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়েও জুয়া খেলেছেন। তাইতো, ছেলেটাকে বিদ্যালয়ের বারান্দাও স্পর্শ করতে দেন নি। ছোট থেকেই তাই সখ্যতা গড়ে উঠে পাড়ার বিদ্যালয় বিমুখ ছেলেগুলোর সাথে। তাছাড়া, বহুবিবাহে আসক্ত বাবা ও মায়ের কথা কাটাকাটি এবং পারিবারিক কলহের কারণে ছেলেটির মনে হয়ত জন্ম নেয় চাপা রাগ। বাবার অকথ্য বকুনি খেয়ে মজে যায় আড্ডাবাজিতে। কথায় আছে, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। একসময় মজে যায় ফ্রী ফায়ার এবং পাবজি নামক সর্বনাশা গেইমে। গেইমে বিভিন্ন আইটেম যেমন ডায়মন্ড কেনার মত অযথা অপব্যায় মাছের ব্যবসার আড়ালে জুয়ার টাকা থাকায় হয়ত ছেলেটির গাঁয়ে লাগেনি । মোটরসাইকেল নিয়ে অযথা ঘোরাফেরা, নিরর্থক আড্ডাবাজি(একজন নিরক্ষর থেকে আপনি কি ধরনের আলোচনা আশা করতে পারেন), নিয়মিত মুভি দেখা আর, বাবার বকুনি খেয়ে মাছের ঘেরগুলো দেখে আসা এই হলো তার পুরো বছরের রুটিন।

তার এই পথচলা যে কত বড় বিপদের ইঙ্গিত বহন করছিল, তা এলাকার মানুষ বুঝতে পারেনি।

একজন পথচারীর জবানবন্দি

রাত সাড়ে বারোটায় রাস্তায় কাজ শেষে ফেরার পথে একজন পথচারী লক্ষ্য করেন, কিছু কিশোর দা দিয়ে ডাব কাটছে এবং উচ্চস্বরে চিৎকার করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলে তারা ভয় দেখানোর চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে তার ওপর হামলা চালায়। এমন আচরণ শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, এটি সমাজের জন্যও একটি অশনিসংকেত।

 

কিশোর অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির কারণ

১. পারিবারিক অবহেলা: সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের অমনোযোগিতা তাদের বিপথগামী করে তোলে।

২. অশিক্ষা ও বিদ্যালয় বিমুখতা: শিক্ষার অভাব কিশোরদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে ঠেলে দেয়।

৩. অসৎ সঙ্গ: অপরাধপ্রবণ বন্ধুদের সাথে মেলামেশার ফলে কিশোররা সহজেই খারাপ পথে পা বাড়ায়।

৪. প্রযুক্তির অপব্যবহার: অতিরিক্ত মোবাইল গেম খেলা, সামাজিক মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় সময় ব্যয় কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তৈরি করে।

৫. আইনের দুর্বল প্রয়োগ: প্রশাসনের নজরদারির অভাব এবং অপরাধীদের প্রতি শিথিল মনোভাব তাদের সাহসী করে তোলে।

৬. আর্থ-সামাজিক বৈষম্য: দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও সামাজিক অসমতা কিশোরদের অপরাধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

পরিসংখ্যান ও গাণিতিক বিশ্লেষণ

গবেষণায় দেখা গেছে, অপরাধপ্রবণ কিশোরদের ৭০% নিরক্ষর বা বিদ্যালয় বিমুখ। অপরাধীদের মধ্যে ৬০% এর পিতা-মাতা সংসারে কলহে লিপ্ত। মোবাইল গেম আসক্ত কিশোরদের মধ্যে অপরাধে জড়ানোর সম্ভাবনা ৪৫% বেশি।

যদি একটি সমাজে ১০০ জন কিশোর থাকে এবং তাদের মধ্যে ৩০ জন বিদ্যালয় বিমুখ হয়, তবে গাণিতিকভাবে কমপক্ষে ২১ জন অপরাধের ঝুঁকিতে থাকে। আবার, পারিবারিক কলহপূর্ণ পরিবেশে বসবাসরত ২৫ জন কিশোরের মধ্যে প্রায় ১৫ জনই অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হতে পারে।

 

প্রতিকার: কী করা যেতে পারে?

১. পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি: অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং তাদের নৈতিক ও মানসিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া।

2. শিক্ষার প্রসার: বিদ্যালয়মুখী করার জন্য সরকার ও সমাজের উদ্যোগ প্রয়োজন।

3. প্রশাসনিক ব্যবস্থা জোরদার করা: কিশোর অপরাধীদের চিহ্নিত করা, আইনের আওতায় আনা এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা দরকার। পুলিশের সক্রিয় নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে, যেন কিশোর গ্যাং ও অপরাধী দল গড়ে উঠতে না পারে।

4. নাগরিক অংশগ্রহণ: সমাজের সবাইকে প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কিশোর অপরাধীদের বিষয়ে তথ্য দেওয়া এবং অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

5. সামাজিক উদ্যোগ: সমাজের সব স্তরের মানুষকে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে অংশ নিতে হবে।

6. সৃষ্টি ও খেলাধুলার সুযোগ বৃদ্ধি: কিশোরদের জন্য ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এবং সৃজনশীল কাজের সুযোগ বাড়ানো অপরাধপ্রবণতা কমাতে সাহায্য করবে।

7. মানসিক সহায়তা প্রদান: কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা দরকার।

8. নেতৃত্ব বিকাশ ও মূল্যবোধের শিক্ষা: কিশোরদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী গড়ে তোলা ও নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

9. কমিউনিটি পুলিশিং: পুলিশ ও সমাজের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে কিশোরদের অপরাধ থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করা

পরিশেষে, কিশোর অপরাধপ্রবণতা একটি সামাজিক সমস্যা, যা পারিবারিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক উদ্যোগের মাধ্যমে মোকাবিলা করা সম্ভব। আমাদের সবার উচিত কিশোর অপরাধের মূল কারণ অনুধাবন করে সচেতনতা সৃষ্টি করা, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো কিশোর বিপথগামী না হয়। প্রশাসনের উচিত কিশোর অপরাধীদের নজরদারিতে রাখা, প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং পুনর্বাসনের মাধ্যমে তাদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা। সুস্থ, সচেতন ও শিক্ষিত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অপরাধপ্রবণতা রোধ করতে হলে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে।